রাজশাহী
নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে
যেতে হয়। এ শহরের প্রাচীন নামটি ছিল মহাকাল গড়। পরে রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায়
রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে রাজশাহী নামটির উদ্ভব কিভাবে হলো এর সুস্পষ্ট কোন
ব্যাখ্যা নাই । ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসে ও রাজশাহী নামক কোন
জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নাই । অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু হিন্দু,
মুসলিম, রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী।
ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের (Bolch Mann) মতে, খ্রিষ্টীয় ১৫শ শতকে গৌড়ের মুসলিম
সালতানাত এই জেলার ভাতুড়িয়ার জমিদার রাজা গণেশ কতৃর্ক আত্মসাতের সময় থেকে
রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়েছে। হিন্দু রাজ আর ফারসী শাহী এই শব্দ দুটির
সমন্বয়ে উদ্ভব হয়েছে মিশ্রজাত শব্দটির। কিন্তু ব্লকম্যানের অভিমত গ্রহণে
আপত্তি করে বেভারিজ (Beveridge) বলেন, নাম হিসেবে রাজশাহী অপেক্ষা অর্বাচীন
এবং এর অবস্থান ছিল রাজা গণেষের জমিদারী ভাতুড়িয়া পরগনা থেকে অনেক দূরে।
রাজা গণেশের সময় এই নামটির উদ্ভব হলে তার উল্লেখ টোডরমল প্রণীত খাজনা
আদায়ের তালিকায় অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থে অবশ্যই পাওয়া
যেত। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী
নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করেন এই জেলার জন্য। অনেকে
এসব ব্যাখ্যাকে যথার্থ ইতিহাস মনে করেননা। তবে ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলার
নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ সালে নবাব মুশির্দকুলী খান সমগ্র বাংলাদেশকে
রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩ (তের) টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে
'চারুলা রাজশাহী' নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি এলাকা নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে
প্রবাহিত পদ্মা বিধৌত 'রাজশাহী চাকলা' কে তিনি উত্তরে বতর্মান রাজশাহী ও
দক্ষিণে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে অপর অংশ রাজশাহী নিজ চাকলা নামে অভিহিত করেন।
প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ-জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি
ছিলেন মুর্শিদ কুলির একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি। যে জন্য নবাব তাকে রাজা
উপাধী প্রদান করেন। দক্ষিণ চাকলা রাজশাহী নামে বিস্তৃত এলাকা যা সমগ্র
রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে অবস্থিত ছিল, তা ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান
নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করেন। এই জমিদারী পরে নাটোরের
রাণী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। রামজীবন প্রথম
নাটোর রাজ ১৭৩০ সালে মারা গেলে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন। ১৭৫১
সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ভবানী দেবী রাণী ভবানী নামে
উত্তরাধীকারী লাভ করেন। অনেকের মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের উপর প্রীতি
বশত এই চাকলার নাম রাজশাহী করেন নবাব মুর্শিদকুলী খান। কিন্তু ঐতিহাসিক
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাণী ভবানীর দেয়া নাম রাজশাহী । অবশ্য মিঃ
গ্রান্ট লিখেছেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার
বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
নবাবী আমল থেকেই বৃহত্তর রাজশাহীর প্রশাসনিক কাযর্ক্রম
পরিচালনা হতো নাটোর থেকে । নাটোর রাজ বৃহত্তর রাজশাহীর প্রশাসনিক প্রধানের
দায়িত্ব পালন করতেন। বৃটিশ শাসনের পত্তন হলেও সে সূত্র ধরে নাটোরই
প্রশাসনিক সদর ছিল। তখন রাজশাহী মহানগর তৎকালীন বোয়ালিয়া ছিল বিখ্যাত
বাণিজ্য বন্দর। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নাটোর ক্রমশ অস্বাস্থ্যকর
হয়ে ওঠে । নারদ নদীর মুখ বালি দ্বারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বন্যার দূষিত
পানি নাটোর শহরে আটকে পড়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শহরবাসি
বিভিন্ন পীড়ায় আক্রান্ত হতে আরম্ভ করে। এই দুরবস্থায় কতৃর্পক্ষ জেলা
সদরদপ্তর রাজশাহীর শ্রীরামপুরে স্থানান্তরিত করে ১৮২৫ সালে। ফলে শ্রীরামপুর
শহরে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ১৮৫০ সালে প্রবল বন্যা হয় এবং শ্রীরামপুর নদী
গর্ভে ভেঙ্গে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী বুলনপুরে সরকারী প্রশাসনিক দপ্তর
স্থানান্তরিত করা হয় ও এখনও সেখানে বিদ্যমান।
No comments:
Post a Comment